সৌদি আরবে মসজিদে নামাজ পড়ার নিয়ম ও মসজিদের নিয়ম কানুন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
বাংলাদেশী মুসলিমরা যখন সৌদি আরব সফর করেন, তখন তাদের জন্য নামাজের খুশি এবং শান্তি উপভোগ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সৌদি আরব ইসলামের জন্মভূমি এবং মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র স্থান, যেখানে মক্কা এবং মদিনার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর অবস্থিত। সৌদি আরবের মসজিদগুলোতে নামাজ পড়ার নিয়ম-কানুন অনেকটা কঠোর এবং সুনির্দিষ্ট। তাই সৌদি আরবে গিয়ে নামাজ পড়ার সময় কিছু বিশেষ নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। এই লেখায় আমরা আলোচনা করব, বাংলাদেশীরা সৌদি আরবে কিভাবে নামাজ পড়বেন ও মসজিদের নিয়ম-কানুন।
১. সৌদি আরবে নামাজের সময়সূচি
সৌদি আরবে নামাজের সময়সূচি মক্কা ও মদিনা, উভয় স্থানেই নির্দিষ্ট। নামাজের সময়গুলি মসজিদগুলোর মাইক সিস্টেম বা নামাজের সময়সূচি পুস্তিকা দিয়ে জানানো হয়। সাধারণত ফজর, যুহর, আসর, মাগরিব, এবং ইশা নামাজের সময় নির্দিষ্ট থাকে।
২. মসজিদে প্রবেশের নিয়ম
সৌদি আরবের মসজিদগুলোর বিশেষ কিছু প্রবেশের নিয়ম-কানুন রয়েছে, বিশেষত মক্কা ও মদিনার মসজিদগুলোতে। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা:
পবিত্রতা নিশ্চিত করুন: মসজিদে প্রবেশের আগে উযু (অবশ্যই হাত-পা ধোয়া) করা আবশ্যক। এ ছাড়া, মসজিদে প্রবেশের আগে আপনি পরিস্কার এবং সাদামাটা পোশাক পরিধান করবেন। যারা মোজা পরিধান করেন তারা মোজা না খুলে মোজার উপর মাসাহ করে থাকেন।
জুতা বাইরে রাখুন: মসজিদে প্রবেশের আগে আপনার জুতা মসজিদের বাইরে বা নির্ধারিত জুতার র্যাকে রেখে ভিতরে প্রবেশ করুন।
পবিত্র কুরআনকে সম্মান দিন: মসজিদে কুরআন শোনা বা স্পর্শ করা হলে তা অত্যন্ত সম্মানের সাথে করা উচিত।
পুরুষ ও মহিলা পৃথক: সৌদি আরবের মসজিদগুলোতে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা নামাজের স্থান রাখা হয়। তাই মসজিদে প্রবেশের সময় এই বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি।
যেকক্ষে মহিলারা নামাজ আদায় করেন তার বাহিরে সাইনবোর্ড বা লেখা আছে যে এই কক্ষ শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য। যারা পড়তে পারেন না তারা মহিলা চিহ্ন দেখে চিনতে পারবেন। এই কক্ষে পুরুষদের প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষেধ।
৩. সৌদি আরবে মসজিদে নামাজ পড়ার নিয়ম।
সৌদি আরবের মসজিদে নামাজের পদ্ধতি বাংলাদেশের মতোই হলেও, কিছু স্থানীয় বিশেষ নিয়ম থাকতে পারে যা জানিয়ে রাখা উচিত:
জামাতে নামাজ পড়ার নিয়ম:
তায়্যেতুল ওজু ও দুখলুল ময়াসজিদ
১. নামাজের সারি
মসজিদে নামাজ পড়ার সময় পুরুষদের জন্য সোজা সারিতে দাঁড়ানো একটি গুরুত্বপূর্ন নিয়ম। নারীদের জন্যও আলাদা সারি থাকলেও, তারা কখনো পুরুষদের সাথেও একত্রিত হতে পারেন না।
২. নামাজের সঠিক অবস্থান
নামাজের সময় কিবলা বা মক্কা এর দিকে মনোযোগী হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সৌদি আরবের প্রতিটি মসজিদে কিবলা নির্দেশক সিস্টেম রয়েছে যা আপনাকে সঠিক দিক নির্দেশ করবে।
রুকু থেকে দাঁড়িয়ে কি দোয়া পড়তে হয়?
সৌদি আরবে আরবগন নামাজ আদায় করার সময় রুকু থেকে সামি আল্লাহ হুলিমান হামিদা বলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর রাব্বানাকাল হামদ। হামদান কাছিরান তয়্যেবান মুবারাকান ফিহ পড়ে থাকে। তারপর ইমাম সাহেব আল্লাহু আকবার বললে সিজদাহ্ এ যায়। আমরা বাংলাদেশীরা সাধারণত রাব্বানাকাল হামদ বলে সিজদাহে চলে যায়।
দুই সিজদাহের মাঝে কি দোয়া পড়তে হয়?
আমরা বাংলাদেশীরা আলেমসমাজ ব্যাতিত সাধারণত দুই সিজদাহের মাঝে কোন দোয়া পড়িনা। আরবগন দুই সিজদাহ্ এর মাঝে নিম্নের দোয়া পড়েন।
আল্লাহুম্মাগ ফিরলি ওর হামনি ওহাদিনি ওয়াফিনি ওরজিকনি।
এই দোয়া পড়তে কিছুটা সময় নেয়।
৩. তাহাজ্জুদ এবং সুন্নত নামাজ
- মক্কা ও মদিনা সহ সৌদি আরবের বিভিন্ন মসজিদে তাহাজ্জুদ, তাহিয়া তুম্মা নামাজ, এবং সুন্নত নামাজ বিশেষ গুরুত্ব পায়। যদি আপনি অতিরিক্ত নামাজ পড়তে চান, তাহলে এই নিয়মগুলো পালন করা উচিত।
৪. মসজিদে শৃঙ্খলা ও সুশৃঙ্খলতা
সৌদি আরবের মসজিদগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। মসজিদে কোনও ধরণের হট্টগোল, উচ্চ শব্দ বা গাফিলতি সহ আচরণ নিষিদ্ধ। এখানে কিছু শৃঙ্খলা বজায় রাখার নিয়ম:
সামাজিক দূরত্ব: মসজিদে মুসল্লিদের জন্য নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয়, বিশেষত যখন অনেক মানুষ একসাথে নামাজ পড়তে আসে।
বিশ্বাসী সঙ্গীরা এবং মসজিদের আয়োজকরা: মসজিদের আয়োজকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং তাদের নির্দেশনা মেনে চলা উচিত।
অতিরিক্ত বস্ত্র বা সামগ্রী সঙ্গে আনা নিষেধ: মসজিদে অপ্রয়োজনীয় উপকরণ বা ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করা এড়ানো উচিত।
কাপড়ে ময়লা থাকলে কিভাবে নামাজ পড়বেন?
মসজিদগুলো অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়। ফ্লোরে ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন কার্পেট বিছানো থাকে। আপনার পরিধেয় কাপড় যদি ময়লা কিন্তু পবিত্র হয় এবং আপনি মসজিদে নামাজ পড়তে চান।তাহলে আপনি মসজিদের ভেতরে নামাজি বা জায়নামাজ পাবেন। আপনি যদি রং মিস্ত্রী বা রাজ মিস্ত্রী হয়ে থাকেন আপনার পোশাকে একটু আধটু ময়লা থাকতেই পারে এটা স্বাভাবিক। আপনি কার্পেটের উপরে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করবেন। তাহলে আপনার পোশাক দ্বারা মসজিদের কার্পেট নোংরা হবেনা।
সৌদি আরবে প্রায় প্রতিটি মসজিদের সীমানা বাউন্ডারির ভেতরে বা বাহিরে সবার জন্য সাদা ট্যাংকির মধ্যে বিনামূল্যে ঠান্ডা ও গরম পানির ব্যাবস্থা আছে। এই পানযোগ্য পানি সবার জন্য উন্মুক্ত। আপনি পান করুন, বোতল ভরে নিয়ে যান।
মসজিদের ভিতরে পানির বোতল কেন থাকে?
মসজিদের ভিতরে ফ্রিজের ভেতর মিনারেল পানির বোতল থাকে। এই পানির বোতল বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মুসুল্লিদের জন্য হাদিয়া দিয়ে থাকেন। আপনি আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী পানি পান করতে পারবেন। নামাজ শেষে সাথে করে পানির বোতল না নেওয়া ভালো। একান্ত যদি নিতেই হয় একটার বেশি নিবেন না। আপনাকে কিছু বলবেনা কিন্তু আপনার হাতে অতিরিক্ত পানির বোতল সৌদি নাগরিকগন ভালো চোখে দেখেন না। আর মসজিদের সীমানা বাউন্ডারির ভেতরে বা বাহিরে সবার জন্য বিনামূল্যে ঠান্ডা ও গরম পানির ব্যাবস্থা আছে। আপনি পান করুন, বোতল ভরে নিয়ে যান কেউ কিছু বলবেনা।
৫. মক্কা ও মদিনার মসজিদে নামাজ
বিশেষ করে মক্কা এবং মদিনার মসজিদে নামাজ পড়ার কিছু অতিরিক্ত নিয়ম এবং সৌদি আরবের আরবিতে বিশেষ সম্মান রয়েছে:
মক্কায় কাবা ঘর দেখা: মক্কায় হাজীদের জন্য কাবা ঘরের সামনে নামাজ পড়ার বিশেষ সুবিধা রয়েছে, তবে সাধারণ মুসল্লিদের জন্যও বিশেষ জায়গা বরাদ্দ থাকে।
মদিনার মসজিদে রওজা শরিফ: মদিনার মসজিদে রওজা শরিফে উপস্থিত থাকলে, নামাজের পর সেখানকার বিশেষ দোয়া করা অত্যন্ত ফলপ্রসূ।
৬. বিশেষ দিনগুলোর নামাজ
সৌদি আরবে ইদুল ফিতর এবং ইদুল আজহা এর নামাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। এসব দিনগুলোতে মসজিদে আলাদা প্রস্তুতি এবং বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
ইদ নামাজের নিয়ম: সৌদি আরবের মসজিদে সাধারণত ইদের দিনে বিশাল নামাজের আয়োজন করা হয়, যেখানে মুসল্লিরা বিশাল জমায়েতের অংশ হিসেবে নামাজ পড়েন।
তওবা ও দুআ: বিশেষ দিনে নামাজ পড়ার পাশাপাশি, ব্যক্তিগত দুআ এবং তওবার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
উপসংহার
সৌদি আরবে নামাজ পড়ার জন্য কিছু বিশেষ নিয়ম-কানুন রয়েছে যা আপনাকে অনুসরণ করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে যে সৌদি আরবের মসজিদগুলো অত্যন্ত পবিত্র, এবং এখানে নামাজের সময় এবং শৃঙ্খলা কঠোরভাবে পালন করা হয়। সুতরাং, বাংলাদেশী মুসলিম হিসেবে সৌদি আরবে গিয়ে এসব নিয়ম মেনে নামাজ পড়া আপনাকে আরও বেশি আধ্যাত্মিক শান্তি এবং আনন্দ প্রদান করবে।
সৌদি আরব থেকে নিজ দেশে ছুটিতে আসার সময় কর্মী কোম্পানি থেকে কি কি সুবিধা পাবেন।