
ফ্রি ভিসা কি? বিস্তারিত জানুন এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। শুরুতেই বলে নেই, প্রকৃতপক্ষে ফ্রি ভিসা বলে কিছুই নেই।
ফ্রি ভিসা শব্দটি প্রায়ই মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশেষ করে সৌদি আরব, কাতার, দুবাই ও ওমানের মতো দেশগুলিতে শোনা যায়। এটি বিশেষত প্রবাসী কর্মীদের কাছে আকর্ষণীয় একটি ধারণা, যেখানে তারা একটি নির্দিষ্ট স্পন্সরের অধীনে কাজ না করে তাদের পছন্দমত বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে পারেন। তবে, ফ্রি ভিসার বেশ কিছু সুবিধা এবং চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা সবার জানা প্রয়োজন।
ফ্রি ভিসা কি?
ভিসা এমন একটি কাজের ভিসা যেখানে প্রবাসী কর্মী কাগজে কলমে যে কফিলের অধীনে সে কফিলের কাজ করে না।কর্মী তার পছন্দমত কাজ খুঁজে কাজ করেন। বিনিময়ে তার কাগজে কলমের বা আসল কফিলকে মাসিক বা বাত্সরিক একটি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ প্রদান করে থাকেন। এটাই কথিত ফ্রি ভিসা। কোনো নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তার অধীনে কাজ না করে নিজের পছন্দমত কাজ করতে পারেন। ফ্রি ভিসাধারী কর্মীদের প্রায়ই “ফ্রিল্যান্সার” বা “স্বাধীন কর্মী” হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ফ্রি ভিসা মানে আসলে “বিনা খরচের ভিসা” নয়; বরং এটি মোটা অংক দিয়ে কেনা হয়। ফ্রি ভিসা বলতে আলাদা কোন কোন ভিসা নেই। এটি বাংলাদেশীদের কাছে বহুল পরিচিত একটি নাম।
ফ্রি ভিসাধারী কর্মীরা নির্দিষ্ট সময় পর পর ইকামা নবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ফি প্রদান করে এবং কফিলের নামে নিবন্ধিত থাকার শর্তে বিভিন্ন চাকরি করার সুযোগ পান।
ফ্রি ভিসা আর ভিসা ফ্রি এর পার্থক্য :
আগেই বলা হয়েছে ফ্রি ভিসা বলতে কিছু নেই। মানুষের মুখে মুখে এটার নামকরণ হয়ে গেছে। এই কথিত ফ্রি ভিসা অর্থ দিয়ে কেনা হয়।
ভিসা ফ্রি বলতে বুঝায় আপনি যে ভিসাটি পেয়েছেন তা বিনামূল্যে পেয়েছেন। এর জন্য কোন প্রকার অর্থ পরিশোধ করতে হয়নি।
ফ্রি ভিসার সুবিধা
ফ্রি ভিসার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা রয়েছে যা অনেক প্রবাসীর কাছে এটি আকর্ষণীয় করে তুলেছে:
1. ইচ্ছামত কাজের সুযোগ: ফ্রি ভিসা নিয়ে প্রবাসীরা নিজেদের ইচ্ছামত বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করতে পারেন। নির্দিষ্ট স্পন্সর বা নিয়োগকর্তার বা কফিলের অধীনে কাজের বাধ্যবাধকতা না থাকায় কাজে অনেক স্বাধীনতা থাকে। ফ্রি ভিসায় কর্মী তার নিজের বস নিজেই। মন চাইলো আজকে কাজ করবে, মন না চাইলে করবেনা।
2. বিভিন্ন আয়ের উৎস: নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অধীনে কাজ করলে একক আয়ের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। কিন্তু ফ্রি ভিসা থাকলে প্রবাসীরা একাধিক কাজে যুক্ত হয়ে আয়ের সুযোগ বৃদ্ধি করতে পারেন।
3. কাজ পরিবর্তনের সুযোগ: ফ্রি ভিসাধারী প্রবাসীরা চাইলে সহজেই কাজ পরিবর্তন করতে পারেন এবং নতুন চাকরিতে যোগ দিতে পারেন।
4. স্পন্সর পরিবর্তন সহজ: ফ্রি ভিসার অধীনে থাকার কারণে প্রয়োজনে স্পন্সর বা কফিল পরিবর্তন করার সুযোগ রয়েছে, যা অন্যান্য ভিসার ক্ষেত্রে কঠিন হতে পারে।
ফ্রি ভিসায় সৌদি আরবে কি কি কাজ পাওয়া যায়?
সৌদি আরবে ফ্রি ভিসায় একজন কর্মী যে যে কাজ করে তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইন্সট্রাকশনের কাজ, প্লাম্বারের কাজ, ইলেক্ট্রিক কাজ, ক্লিনারের কাজ, মসজিদের খাদেমের কাজ, গাড়ির সার্ভিসিং, বাসা বাড়ি, অফিস ক্লিনিং এর কাজ প্রভূতি।
আপনার ইকমা বা আকামার জন্য কফিল বা কোম্পানি টাকা জমা দিয়েছে কিনা চেক করুন এই খানে ক্লিক করে।
ফ্রি ভিসার অসুবিধা
ফ্রি ভিসার যেমন সুবিধা রয়েছে, তেমনি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে যা প্রবাসীদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
1. অস্থিরতা: ফ্রি ভিসায় স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা কম থাকে। কোনো নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তার অধীনে না থাকায় কাজের ধরন ও সময়সীমা প্রায়ই অস্থির থাকে। ফ্রি ভিসার কর্মীকে নিজের কাজ নিজেই খুঁজে বের করতে হয়। অনেক সময় কাজের সংকটে রুমে বেকার বসে থাকতে হয়।
2. অতিরিক্ত খরচ: ফ্রি ভিসায় ইকামা নবায়ন, স্বাস্থ্য বীমা, এবং অন্যান্য সরকারি খরচের দায়িত্ব প্রবাসীকেই নিতে হয়, যা স্বাভাবিক ভিসার তুলনায় বেশি খরচ। পাশাপাশি কফিল ফায়দা জোগাড় করতে হয়।
3. বেআইনি কাজে জড়ানোর সম্ভাবনা: অনেক প্রবাসী ফ্রি ভিসার অধীনে বেআইনি বা অননুমোদিত কাজে জড়িয়ে পড়েন। এটি সৌদি আরবের মতো দেশে আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এর ফলে প্রবাসীরা জরিমানা বা নির্বাসনের মুখোমুখি হতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে এক কফিলের অধীনে থেকে অন্য কফিলের কাজ করা সৌদি আরবে বে-আইনি। পুলিশ কোন প্রবাসীকে কাজের মধ্যে হাতে নাতে ধরা পড়লে দেশে পাঠিয়ে দেয়।
4. প্রতারণার ঝুঁকি: অনেক দালাল বা এজেন্ট ফ্রি ভিসার নামে অর্থ আদায় করেন এবং পরবর্তীতে প্রবাসীদের সাথে প্রতারণা করে। ফলে প্রবাসীরা সমস্যার মুখে পড়েন।
5. সরকারি নজরদারি: ফ্রি ভিসায় কাজ করলে বিভিন্ন সময়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি বেড়ে যেতে পারে, কারণ এর মাধ্যমে কিছু অবৈধ কার্যক্রম হতে পারে।
একজন ফ্রি ভিসার কর্মী কি মেয়াদ শেষে কফিল বা কোম্পানি থেকে হিসাব বা সার্ভিস ইন্ড রিওয়ার্ড পাবেন?
উত্তর হচ্ছে না। একজন ফ্রি ভিসার কর্মী মেয়াদ শেষে কফিল বা কোম্পানি থেকে হিসাব বা সার্ভিস ইন্ড রিওয়ার্ড পাবেন না। শুধু তাই নয় কর্মী ছুটিতে গেলে প্রতি বছরে ২১ দিনের বেতন পাবেন না।
ফ্রি ভিসা নেওয়ার ক্ষেত্রে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করবেন?
ফ্রি ভিসার ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা প্রবাসীদের প্রতারণা এবং বিভিন্ন জটিলতা থেকে রক্ষা করতে সহায়ক হতে পারে। নিচে কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হলো:
1. বিশ্বস্ত এজেন্টের মাধ্যমে ভিসা গ্রহণ: ফ্রি ভিসার ক্ষেত্রে কোনও এজেন্টের সাহায্য নিতে হলে অবশ্যই পরিচিত এবং বিশ্বস্ত এজেন্টের মাধ্যমেই এটি করা উচিত।
2. চুক্তি ভালভাবে পর্যালোচনা: ফ্রি ভিসা নেওয়ার আগে চুক্তির শর্তাবলী ভালভাবে পড়ে নেয়া এবং বোঝা প্রয়োজন, যাতে প্রয়োজনের সময় কোনো সমস্যা না হয়।
3. কাজের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা: ফ্রি ভিসা নিয়ে কাজে যোগ দেয়ার আগে কাজের সুযোগ এবং স্থায়িত্ব সম্পর্কে ভালভাবে যাচাই করে নিন।
4. আইন মেনে চলা: সৌদি আরবের নিয়ম এবং আইন অনুযায়ী কাজ করা উচিত। অবৈধ কাজের ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
5. ডকুমেন্ট সংরক্ষণ: ফ্রি ভিসা সংক্রান্ত সকল গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট নিজের কাছে রাখুন, যাতে প্রয়োজনের সময় তা ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশ থেকে ফ্রি ভিসায় সৌদি আরব যেতে কত টাকা লাগে?
বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব যেতে কত টাকা লাগে সেটা কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে।যেমন ভিসার দাম, ভিসা প্রসেসিং খরচ, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, ট্রেইনিং, যাতায়াত খরচ, বিমান টিকেট ইত্যাদি।
পাসপোর্ট করা ১০০০০ টাকা।
নাগরিক সনদপত্র ১০০ টাকা
পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ১০০০ টাকা।
ট্রেইনিং করা ২০০০ টাকা।
মেডিকেল টেস্ট ১০০০০ টাকা
তাশির ফিংগার ফি ৬৬২ টাকা।
ভিসা প্রসেসিং ২০০০০ টাকা।
ফিংগার ফি ১০০০ টাকা।
ভিসার দাম ৮০০০০-১৮০০০০ টাকা।
বিমান টিকেট ৭০০০০-৮০০০০ টাকা।
যাতায়াত খরচ ১০০০০ টাকা।
এখানে যাতায়াত খরচ পাসপোর্ট করতে যাওয়া, পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে আসা যাওয়া, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সনদ সংগ্রহ করতে আসা যাওয়া, মেডিকেল করতে আসা যাওয়া, ফিংগার দিতে আসা যাওয়া, ট্রেইনিং করতে আসা যাওয়া যেদিন আপনার ফ্লাইট এয়ারপোর্ট অব্দি যাওয়ার খরচ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আপনার বাড়ি থেকে উক্ত স্থানগুলোর দূরত্বের উপর যাতায়াত খরচ প্লাস মাইনাস হতে পারে।
এভাবে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যেতে একজন কর্মীর ২৫০০০০ থেকে ৪৫০০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। ভিসা যদি কোম্পানি আপনাকে বিনামূল্যে দেয় তাহলে ভিসার মূল্য বাদ যাবে।
ফ্রি ভিসায় একজন কর্মীর মাসিক খরচ কত?
যেহেতু ফ্রি ভিসায় কর্মীকে তার সম্পূর্ণ খরচ নিজেকেই বহন করতে হয়, তাই যেকেউ ফ্রি ভিসায় সৌদি আরব আসার আগে হিসাব নিকাশ করে আসাই ভালো। নিচে ফ্রি ভিসার একজন কর্মীর আনুমানিক মাসিক খরচের হিসাব দেওয়া হলো।
বাসা ভাড়া ৩০০ রিয়াল।
খাওয়া ৩০০ রিয়াল।
ওয়াইফাই বিল ৫০ রিয়াল
কফিল ফায়দা ৩০০-৪০০ রিয়াল
ঔষধপত্রসহ অন্যান্য ৫০ রিয়াল।
এভাবে মাসে একজন ফ্রি ভিসার কর্মীকে ১০০০-১২০০ রিয়াল খরচ করতে হয়। এছাড়া ইকামা বা আকামা নবায়ন ফি, দেশে ছুটিতে আসার ফি, বিমান টিকেট খরচ নিজেকেই বহন করতে হয়।
মোটকথা ফ্রি ভিসায় কর্মীকে মাসে ৩০০০ রিয়াল রোজগার করতেই হবে। ৩০০০ রিয়াল আয় করলে খরচ বাদ দিয়ে ১৫০০ রিয়াল হাতে থাকবে।
ফ্রি ভিসা কিভাবে চেক করবেন?
ফ্রি ভিসা আর কোম্পানির ভিসা চেক করার পদ্ধতি একই।সৌদি আরবে থাকা প্রবাসীরা ফ্রি ভিসার সত্যতা যাচাই করতে Absher অ্যাপে একাউন্ট খুলে লগইন করে যাচাই করতে পারেন। ইকামা নম্বর এবং স্পন্সরের তথ্য দেখে নিশ্চিত হতে পারেন ভিসা আসল কিনা।
কথিত ফ্রি ভিসায় সৌদি আরব গিয়ে কর্মহীন হয়ে আছে হাজারো প্রবাসী।
সৌদি আরবে যেতে নূন্যতম বয়স
বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে কাজের উদ্দেশ্যে যেতে বয়স কমপক্ষে ২১ বছর হওয়া লাগে। এই বয়স অবশ্যই পাসপোর্ট অনুযায়ী ২১ বছর হতে হবে। তবে ভ্রমণ বা উমরাহ এর উদ্দেশ্য সৌদি আরবে আসতে বয়সের কোন বাধা নেই।
উপসংহার
ফ্রি ভিসা প্রবাসী কর্মীদের জন্য একটি স্বাধীনতার প্রতীক হলেও এটি যথেষ্ট দায়িত্ব এবং সচেতনতার সাথে ব্যবহার করা উচিত। ফ্রি ভিসা নিয়ে সৌদি আরবে কাজ করার স্বাধীনতা পাওয়া গেলেও এর সাথে যুক্ত চ্যালেঞ্জ এবং ঝুঁকির দিকগুলি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত। সঠিক সিদ্ধান্ত, আইন মেনে চলা, এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করে ফ্রি ভিসা নিয়ে সৌদি আরবে সফলভাবে কাজ করা সম্ভব।
বিদেশ যাওয়া সংক্রান্ত যেকোন তথ্যের জন্য কমেন্ট সেকশানে কমেন্ট করে জানান। প্রবাসী হেল্প ডট কম আপনার সাথেই আছে।